মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অবসরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের তৃতীয় অধ্যায়ের শুরু হয়েছে। এই কথাটি ভুল প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ কম যদি প্রথম অধ্যায়টা ১৯৮৬-২০০৬ পর্যন্ত ধরা হয়। যেখানে বীজ বপন হয়েছে ভবিষ্যতের। পরে ২০০৭ থেকেই জাতীয় দলে খেলছেন পঞ্চপাণ্ডবের সবাই। সেই থেকে ২০২৫-এর শুরুর অংশ পর্যন্ত সময়টাকে দ্বিতীয় অধ্যায় ধরাই যায়। এই অংশেই আছে বেশ কিছু সাফল্যের গল্প। বড় শিরোপার গল্প না থাকলেও দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠাটা এই সময়েই, যা হয়েছে পঞ্চপাণ্ডবের হাত ধরেই। সিংহভাগ সফলতাই হোম অব ক্রিকেট মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। এই মাঠকে আপাদমস্তক মুখস্থ খেলোয়াড়দের। অথচ তাদের অবসরের বেলায় সেই মাঠই অবহেলিত! পঞ্চপাণ্ডবের তিন জনেরই কাগজে-কলমে শেষ জাতীয় দলের অধ্যায়। কেবল সাদাপোশাকে আছেন মুশফিকুর রহিম। মাশরাফি টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেও ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেননি। তাই কাগজে-কলমে তার অবসরের ঘোষণা এখনো বাকি। যদিও সে সম্ভাবনা কমই।
জাতীয় দলে পঞ্চপাণ্ডবের অবদান নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সিনিয়রদের মধ্যে মাশরাফি ছাড়া সবাই ক্যারিয়ারের গোড়াপত্তন করেছেন দেশের বাইরে। তবে পাঁচজনের কারোরই অবসরের সাক্ষী হয়নি দেশের মাঠ ও সমর্থকরা। মাঠ থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েও সেটি বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি সাকিব আল হাসান। মূলত রাজনৈতিক কারণেই সম্ভব হয়নি তার অবসর নেওয়া।
যে মাশরাফি সবার আগে ২০০১ সালে শুরু করেছিলেন ক্যারিয়ার। একমাত্র তিনিই দেশের মাটিতে শুরু করেন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ যখন একের পর এক ম্যাচ ডুবিয়ে যাচ্ছিল তীরে এসে তরী, তখন ইনজুরিপ্রবণ মাশরাফির কাঁধেই আসে অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব। এরপর দলকে পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই ২০১৫ ওানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথমবারের সিরিজ জয়ও এসেছে তারই হাত ধরে। ২০২০ সালে অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর তাকে সিলেটের মাঠে সম্মাননা জানায় বিসিবি। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে আর তাকে দলে রাখা হয়নি। গেল ৫ বছর জাতীয় দলের বাইরে থাকা মাশরাফি এখনো দেননি অবসরের ঘোষণা। ২০২০ এর মার্চ পরবর্তী অংশটাকে তার অবসরকালীন সময় ধরে নেওয়া যায় হয়তো। কিন্তু মাঠে দাঁড়িয়ে ভক্ত ও সমর্থকদের সামনে অবসরের ঘোষণা দিতে পারেননি এবং আর দেওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে।
২০২২ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ চলাকালীন আকস্মিক চট্টগ্রামের একটি হোটেলে অশ্রুসিক্ত নয়নে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম ইকবাল। তার এমন সিদ্ধান্ত হতবাক করে দেয় সবাইকে। পর দিন মাশরাফি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অবসর ভেঙে ফিরে দুই ম্যাচ মাঠে নামলেও বহু নাটকীয়তায় বিশ্বকাপে আর যাওয়া হয়নি। এরপর তার দলে ফেরা কিংবা না ফেরা নিয়েও হয়েছে অনেক জল্পনা। সবশেষ জানুয়ারির ১০ তারিখ তামিম নিজেই ফেসবুকে এক পোস্টে জানিয়ে দেন জাতীয় দলের সঙ্গে তার দূরত্ব আর ঘুচবে না। টি-টোয়েন্টিতে যেভাবে ফেসবুকে অবসর নিয়েছিলেন, একইভাবে পুনরায় ফেসবুকেই বিদায় বলে দেন।
তামিমের ফেসবুক অবসর শুরু ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি দিয়ে। তার দেখানো পথে একই বছর ফেসবুকে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন মুশফিকও। সদ্যসমাপ্ত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দলীয় ব্যর্থতার দায় এসে পড়ে সিনিয়র ক্রিকেটারদের ওপরও। রান আসেনি মুশফিক কিংবা মাহমুদউল্লাহ কারও ব্যাটেই। সমালোচনার মুখেই বলা যায় ওয়ানডে থেকে মুশফিক দেন অবসরের ঘোষণা। যেই হোম অব ক্রিকেটে দিনের পর দিন ঘাম ঝরিয়েছেন সেখানে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে অবসর না নিয়ে ফেসবুককেই বেছে নিয়ে বঞ্চিত করেছেন নিজের ভক্ত ও সমর্থকদের। টেস্টকে বিদায় জানিয়েছেন ২০২১ সালে জিম্বাবুয়েতে আর গেল বছর ভারতের মাটিতে টি-টোয়েন্টিতে।
সবশেষ ব্যতিক্রম কিছু করেননি রিয়াদও। ক্রিকেট পাগল জাতির সমর্থকদের আশা ছিল পঞ্চপাণ্ডবের বিদায় গ্যালারিতে বসে দেখার, কিন্তু সেটি হলো কই! ফর্মের সঙ্গে লড়াই করতে করতেই বোধহয় মাহমুদউল্লাহও ফেসবুক স্ট্যাটাসকেই নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার সেরা মাধ্যম ভেবেছেন। শ্রীলঙ্কার মাটিতে ওয়ানডে দিয়ে ২০০৭ সালে শুরু মাহমুদউল্লাহর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। একই বছর কেনিয়ার নাইরোবিতে টি-টোয়েন্টি ও ২০০৯ সালে উইন্ডিজে শুরু তার টেস্ট ক্যারিয়ার। কিন্তু তিনি টেস্ট থেকে অবসর নেন ২০২১ সালে জিম্বাবুয়ের মাটিতে। গেল বছর টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন ভারতের মাটিতে। ঘরের মাঠে কোনো এক সিরিজ খেলে ওয়ানডেকে বিদায় জানানোর গুঞ্জন থাকলেও, সেটিকে ভুল প্রমাণ করে ফেসবুককেই বেছে নিলেন রিয়াদ। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে বিদেশের মাটিতে অবসর নেওয়া একমাত্র তিনিই পেয়েছেন জিম্বাবুয়ে ও ভারতে পঞ্চপান্ডবদের মধ্যে গার্ড অব অনার।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিন থেকে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করে যাওয়া সাকিবই দেখিয়েছিলেন মাঠ থেকে অবসরের আগ্রহ। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য হওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে ঘরের মাঠে সাকিবের অবসর সম্ভাবনাও ক্ষীণ বলা চলে। ওয়ানডে থেকে অবসর না নিলেও তিনি টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন। যেখানে শেষ ম্যাচ রয়েছে প্রবাসে। গত বছর নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। নাগপুরেই তিনি জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষেই ছিল তার শেষ ম্যাচ। যেটি তিনি খেলেছিলেন সেন্ট লুসিয়ায়। ওয়ানডেতে অবসরের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে কিন্তু তাকে দলেই নেওয়া হয়নি।
ঘরের মাঠ থেকে অবসরের সম্ভাবনা আছে শুধু মুশফিকুর রহিমের। যদি তা তার পরিকল্পনার সঙ্গে মেলে। আর যদি কী-বোর্ড চেপে নেন, তবে দেশের সমর্থকদের বঞ্চিত করার ষোলোকলাই পূর্ণ হবে!