মোটামুটি নীরবে-নিভৃতেই চলে গেল সাতই মার্চ। এর আগে প্রতিবছর দিনটি পালন করা হতো সাড়ম্বরে। ৬ তারিখ গভীর রাত থেকে শুরু হতো। ৭ তারিখ পেরিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মাইক্রোফোনে উচ্চৈঃশব্দে বাজতে থাকত মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ। ওটা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে অখণ্ড পাকিস্তানে জনসভায় দেওয়া তার শেষ ভাষণ। পাড়া-মহল্লার সবখানে চারদিক থেকে ভেসে আসা সেই ভাষণের উচ্চৈঃশব্দে কান পাতা দায় হতো। পাশাপাশি চলত কাঙালিভোজের নামে খিচুড়ি বা তেহারি বিলানোর উৎসব। এসব উৎসবের আয়োজনে বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই চলত আওয়ামী পরিবারভুক্ত নানা রকম লীগের এবং তাদের হাইব্রিড সংস্করণের চাঁদাবাজির মচ্ছব। কোটি কোটি টাকার বাধ্যতামূলক চাঁদা আদায় চলত সবখানে। আর রাষ্ট্রীয় ব্যয় ও উদ্যোগের অনুষ্ঠান তো ছিলই। এবার কিন্তু তার কিছুই ছিল না। কোথাও মাইকে ভাষণ বাজেনি। ভক্তিতে গদগদ কণ্ঠে আলোচনা, কবিতা, গান হয়নি। হয়নি চাঁদাবাজি ও কাঙালিভোজের উৎসব। মুজিবের নামে ছবি, পোস্টার, দেয়াললিখন চোখে পড়েনি এবং স্লোগানও কানে আসেনি। চুপিসারেই পেরিয়ে গেল দিনটি। তাতে বাংলাদেশ ফের পাকিস্তান হয়ে যায়নি, আমাদের স্বাধীনতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি কিংবা দেশের মানুষের জীবনযাপনেও হয়নি তেমন কোনো হেরফের।
বিগত চব্বিশ সালের জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে মুজিবকন্যা হাসিনার ফ্যাসিবাদী রেজিমের পতনের পর প্রথম সাতই মার্চ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। এতকালের শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বন্দনা চুপসে গেছে। রাষ্ট্র এবং সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির মদদ ছাড়া যে এই ভক্তিচর্চা সচল থাকে না, তা প্রমাণিত হয়েছে। হাসিনার আওয়ামী জামানায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উদযাপিত ৮টি ‘জাতীয় দিবস’ গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাতিল করে দেয়। এর একটি হচ্ছে সাতই মার্চ শেখ মুজিবের ভাষণ দিবস।২০২০ সালের আগ পর্যন্ত দিনটিকে কোনো দিবস হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম বিচার বিভাগকে ব্যাপকভাবে দলীয়করণ করে এবং অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আদালত থেকে ঘোষণা করানো ছিল তাদের একটা অপকৌশল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ থেকে সাতই মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে এক মাসের মধ্যে গেজেট জারির নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মুজিববর্ষ উপলক্ষে সব জেলা ও উপজেলায় ‘বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল’ স্থাপনের নির্দেশও দেওয়া হয়।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং বিপুল আয়োজনে বড় পরিসরে দিনটি পালন শুরু হয় ২০২১ সাল থেকে। সাতই মার্চ ঘিরে আওয়ামী বলয়ভুক্তদের কর্মসূচি আগেও থাকত, কিন্তু দিবস ঘিরে নানা আড়ম্বরের শুরুটা ২০২১ সাল থেকেই বলা যায়।হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর সর্বব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা ও লবিংয়ের ফলে ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির উপদেষ্টা কমিটি সাতই মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশ করে। ইউনেস্কো মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে তখন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হয় সব মহাদেশ থেকে ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট বা কালেকশন। ইউনেস্কোর যে উপদেষ্টা কমিটি এ মনোনয়ন দেয় সেই কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভসের মহাপরিচালক ড. আবদুল্লাহ আল-রাইসি।
আন্তর্জাতিক সংস্থার এই স্বীকৃতি অর্জনের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও হাসিনা রেজিম সাতই মার্চের এক বড় স্বীকৃতি লাভে সমর্থ হয়। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ২০২৩ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের বর্ষব্যাপী কর্মসূচিতে ৭ মার্চ উদযাপন অন্তর্ভুক্ত করে। প্রথমবারের মতো বিএনপির ওই কর্মসূচি সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম, ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃতি ও ক্ষমতাসীনদের দলীয় সংকীর্ণতা আমাদের দেশে জনমানস ও পরিস্থিতিকে ভীষণ নাজুক করে রেখেছে। এ অবস্থায় ৭ মার্চ উদযাপনে বিএনপি কতটা নির্মোহ থাকতে এবং বস্তুনিষ্ঠতা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে তা দেখতে হবে। আমাদের দেশে বড় দলগুলোর ভূমিকার কারণে প্রয়াত রাজনীতিকদের কেউই আজ পর্যন্ত সর্বজনমান্য জাতীয় নেতার অবস্থান লাভ করতে পারেননি। সবাই দলীয় গণ্ডিতে বন্দি। এ অবস্থায় এক দলের নেতার ভূমিকা অন্য দল নাকচ ও তুচ্ছ করতে মুখিয়ে থাকে। ফলে আওয়ামী লীগ নেতার ভাষণকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি গ্রহণকে বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকরা ভালোভাবে নেবেন কিনা সন্দেহ আছে, বিশেষ করে আওয়ামী ঘরানা যে সময়টাতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা এবং তার স্মৃতি মুছে ফেলার উদ্যোগ জোরদার করেছে। এমন উদারতাকে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে রিসিপ্রোকেট করার সম্ভাবনাও নেই। কারণ এটা তাদের চরিত্রের এবং দলীয় রসায়ন ও কালচারের বাইরে। দেশের জনচিত্তও এখন কিন্তু প্যাথলজিক্যালি ডিভাইডেড। তা ছাড়া আজ দেশে জাতীয় ঐক্য, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্রের যে সংকট তাতে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন ও ইতিহাসের পুনঃপাঠ জনচিত্তে কতটা আবেদন সৃষ্টি করবে তা নিয়েও আমার মনে ঘোরতর সন্দেহ রয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ইতিহাসে নানা খণ্ডে বিভক্ত। ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান পর্বে, স্বাধীনতার প্রাক্কালে, স্বাধীনতার পর শাসক হিসেবে এবং সব শেষে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির প্রবর্তক হিসেবে তার ভূমিকা তাই আলাদা করেই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নযোগ্য। এ কাজে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিদীপ্ততার প্রয়োজন আছে। সেটা বিএনপি কতটা নৈপুণ্যের সঙ্গে করতে পারবে জানি না। এই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বর্তমান সময়টাই উপযুক্ত ও যথাযথ কি না, তা-ও নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। এ কালে একতরফা এই উদার ‘মুভ’ বিএনপিকে কোনো রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড দেবে, নাকি দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হবে আমি সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নই। আমার নিজের ধারণা, ইতিহাস পর্যালোচনা এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনাবলি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিএনপি এতকাল ধরে স্কিপ করে যাওয়ার একটা অলস ও চতুর ভূমিকা পালন করেছে। ফলে যে যার মতো করে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে এবং একেক সময় একেক রকম অবস্থান নিয়েছে। তাই তাদের এখনকার ভূমিকাকে অনেকের কাছেই অসংলগ্ন ও চাঞ্চল্যকর বলে মনে হতেই পারে। তবে বিএনপি বরাবর নিজেদের জাতীয় ঐক্য ও সমন্বয়ের রাজনীতিতে বিশ্বাসী বলে ঘোষণা করে এসেছে। রাষ্ট্রীয় সব অ্যাপারেটাস ও শক্তির অপব্যবহার করে দল হিসেবে বিএনপিকে তছনছ করার মাধ্যমে জাতীয় জীবনের সেই ঐক্য ও সমন্বয়ের রাজনীতিও ছত্রখান করা হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর সুযোগে আবারও ঐক্য ও সমন্বয়ের রাজনীতির এই অতি ক্ষীণ উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে নিঃসংশয় হওয়া যাচ্ছে না। চালকের আসনে না থেকে এমন উদ্যোগ নিলে তা সফল হওয়ার কোনো নজির নেই।
বিএনপির সাতই মার্চ উদযাপনের ব্যাপারে আমার সতর্ক প্রতিক্রিয়া কতটা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে সেটা বিচার না করেও বলা যায় যে, দলটি এরপর আর সাতই মার্চ পালন করেনি। কারণ বিএনপি সাতই মার্চ পালন করলেও আওয়ামী লীগ মুজিবকন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাতে সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি এক মস্ত প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাতই মার্চ এমন একটি ভাষণ দেওয়ার কর্তৃত্ব ও বৈধতা শেখ সাহেব অর্জন করেছিলেন জনগণের নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির নেতা হওয়ার কারণে। তার মানে, পাকিস্তানে সামরিক শাসকদের আয়োজিত একটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু হাসিনা স্বাধীনতার চেতনার ফেনায়িত উচ্ছ্বাসে নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠান। বিরাট রেসকোর্স ময়দানে শেখ সাহেব অবাধে বিশাল সমাবেশ করতে পেরেছেন। জনতা লাঠি ও বল্লম নিয়ে তাতে যোগ দিতে পেরেছে। পুলিশ কিন্তু সে সমাবেশ নিয়ে কোনো টালবাহানা করেনি, অনুমতি আটকে দেয়নি, জনগণকে আসতে পথে পথে বাধা দেয়নি, যানবাহন বন্ধ করেনি, এমনকি বাসার সামনে বালুর ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে শেখ সাহেবকে সমাবেশে আসতে বাধাও দেয়নি। এমন একটি ভাষণ দেওয়ার পর তাকে আটকও করেনি; হাসিনার বাংলাদেশে যেসব কাণ্ডকীর্তি সবাই হরহামেশাই দেখেছে। সাতই মার্চের ভাষণে শেখ সাহেব যেসব অধিকারের জন্য চিৎকার করেছিলেন এবং তিনি নিজে অবাধে যেসব অধিকার ভোগ করেছিলেন, তার কন্যার সরকার স্বাধীন দেশে তার সবই কেড়ে নেয়। স্বাধীন দেশের শাসক হওয়ার পর বাকশাল প্রবর্তক মুজিব নিজেও মানুষের প্রায় সব অধিকার ভূলুণ্ঠিত করেছিলেন। এসব ঘটনাক্রমে সাতই মার্চের ভাষণ তার সব মহিমা ও অন্তঃসার হারিয়ে নিছক একটি ঐতিহাসিক ডকুমেন্টে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালের সাতই মার্চ অখণ্ড পাকিস্তানের এক অন্তিম দিনে দেশের জনগণের নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় তার জীবনের সেরা বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে সামরিক শাসকদের ওপর সর্বোচ্চ চাপ তৈরির লক্ষ্যে তখনকার পটভূমিতে এর চেয়ে ভালো বক্তৃতা আর হতে পারে না। এটি ছিল একদিকে প্রবল আবেগ ও উদ্দীপনা সঞ্চারী, অন্যদিকে খুবই কৌশলী। তবে আবেগ-উচ্ছ্বাস বর্জিত নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করলে এটি ছিল সব বিবেচনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ একটি ভাষণ। কেননা এ ভাষণ তার ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। নরমে-গরমে, নানা শর্ত জুড়ে, দাবি পেশ করে, কর্মসূচি দিয়ে, নালিশ জানিয়ে, বিভিন্ন রকম হুমকি দিয়ে তিনি নাতিদীর্ঘ যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা ছিল শাসনক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে জনতা ও শাসক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলে ভরা। কিন্তু নির্বাচিত হয়েও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা তিনি পাননি। ভাষণের মাধ্যমে তৈরি করা চাপ, আন্দোলন, কৌশল এবং মার্চের শেষ প্রান্তের আলোচনা সবই ব্যর্থ হয়েছিল।
শাসক শ্রেণি তার সঙ্গে প্রতারণা করে এবং আলোচনার আড়ালে আন্দোলন-প্রতিরোধ সব দমিয়ে দিতে কাপুরুষোচিত আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্যদিকে জনতাও নিয়ন্ত্রণে থাকেনি তার, বরং সশস্ত্র আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিহীন এক সশস্ত্র লড়াই শুরু হয় এবং অতি দ্রুত তা স্বাধীনতাযুদ্ধে উন্নীত হয় বাঙালি সৈনিকদের অংশগ্রহণের ফলে। সাতই মার্চের ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যাভিসারী ছিল বলে পরবর্তীকালে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। কিন্তু এই বক্তৃতা দেওয়ার পরও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য শেখ সাহেবের দফায় দফায় বৈঠক ও অন্যান্য তৎপরতা প্রমাণ করে যে, স্বাধীনতা নয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করাই ছিল তার অভীষ্ট লক্ষ্য। অবশ্য সেটা দোষের ছিল না। নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে সেটা তার ন্যায্য প্রাপ্য ছিল। তবে পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, এই ভাষণ চরম কৌশলী হওয়া সত্ত্বেও দুই তরফেই ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়।এই ভাষণের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনা শাসকদের প্রবল চাপের মুখে ফেলতে চাইলেও তা হয়নি। বরং এতে স্বস্তি বোধ করে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মন্তব্য করেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে ভালো বক্তৃতা। অন্যদিকে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে যিনি বেতারকেন্দ্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, সেই বাঙালি সেনা অফিসার, মেজর জিয়ার কাছে সাতই মার্চের ভাষণটি ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বলে মনে হয়েছিল। অথচ স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেওয়ার মতো এমন কোনো গ্রিন সিগন্যাল শেখ সাহেব দিতে চাননি। বরং ২৫ মার্চ রাতে সম্ভাব্য সামরিক হামলার ব্যাপারে নিশ্চিত আগাম খবর পেয়েও তিনি পরদিন হত্যার প্রতিবাদে হরতালের চেয়ে আর কোনো বড় পদক্ষেপ নিতে রাজি হননি। কাজেই সাতই মার্চের ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে ‘সেদিন থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো’ বলে যত আবেগঘন কবিতা উচ্চারণই করা হোক না কেন, বাস্তব তথ্য অনুযায়ী তা সত্যনিষ্ঠ নয়।
শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে তার এ প্রস্তুতির আহ্বান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আহ্বান ছিল না। একই ভাষণে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদ্দেশে চার দফা এমন দাবি পেশ করেছিলেন, যা খুব সহজেই মেনে নেওয়ার যোগ্য ছিল। সেই দাবিগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন ‘অ্যাসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে প্রথম, সামরিক আইন, মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।’ তার এই দাবিগুলো ছিল আসলে অ্যাসেম্বলিতে বসার পূর্বশর্ত, স্বাধীনতার ঘোষণা নয়। তিনি তার ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি উচ্চারণের মাধ্যমে। এরপর তিনি ইয়াহিয়া, ভুট্টোসহ পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন আপসরফায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে। এতে প্রমাণ হয় যে, মুক্তি ও স্বাধীনতা শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে তিনি ইনডিপেনডেন্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা বলেননি। বাংলায় স্বাধীনতা ও মুক্তি শব্দে নাগরিক অধিকারও বোঝায়; যেমন আমরা বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলি, অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলি। শেখ সাহেব তেমন মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের কথাই সেদিন বলেছিলেন।
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।